হঠাৎ দেখা
-জয়তী মিত্র
বহুবছর বাদে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে রঞ্জন। তার ছোট কাকার ছোট মেয়ে পলির বিয়ে উপলক্ষে তার গ্রামে ফেরা। বাবা, মা অনেকদিন আগেই চলে এসেছে। রঞ্জন চাকরী সূত্রে প্রবাসে থাকে। সেখান থেকে সোজা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে শেষ গ্রাম সংলগ্ন রেল টেশনে এসে পৌঁছায়। রাত তখন প্রায় নয়টা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। একটা মাত্র অটো দাঁড়িয়ে আছে। আর কোন যানবাহন নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে রাস্তা জলে ভরে গেছে। বৃষ্টির জন্য লোকজন তেমন নেই বলে সব বাড়ি চলে গেছে, একজন ছাড়া। এত বছরে চেনা জায়গাগুলো কত পরিবর্তন হয়ে গেছে।
কিছু চেনা যাচ্ছে না। বাবার বদলির চাকরী ছিল। সেই সূত্রে তারা বহুবছর বাইরে, বাইরে কাটিয়েছে। রিটায়ার করার পর কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকে। এর আগে জেঠুর মেয়ে, আর কাকার বড়ো মেয়ের বিয়ের সময় রঞ্জনের বাবা, মা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু রঞ্জন তখন পড়াশুনার জন্য অন্য রাজ্যে ছিল। ছুটি পায়নি বলে আসতে পারেনি। কত বছর পরে দিদিদের সাথে তার দেখা হবে। ভীষণ আনন্দ হবে।
স্টেশন থেকে রঞ্জনদের পৈতৃক বাড়ি প্রায় পঁচিশ মিনিটের পথ। রঞ্জন ভাবলো, ভাগ্যিস একটা অটো ছিল না হলে এই বৃষ্টি মাথায় করে তাকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হতো।
অটোর কাছে গিয়ে রঞ্জন বললো, তালবাগান যাবে? অটো চালক বললো, যাবো। আপনি কাদের বাড়ি যাবেন? রঞ্জন বললো, বিমল রায়দের বাড়ি যাবো। একথা শুনে অটোচালক বললো, আপনাকে চেনা, চেনা লাগছে। আপনি রঞ্জন? রঞ্জন বললো, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমাকে কি করে চিনলেন? অটোচালক এবার আপনি থেকে সরাসরি তুই-তে নেমে এসে বললো, আরে আমি পল্টু আমাকে চিনতে পারলি না, অবশ্য না চেনারই কথা,সেই কত বছর আগের কথা। রঞ্জন এইবার ছোটবেলার বন্ধুকে চিনতে পেরে বললো, তুই সেই পল্টু! কত খেলেছি, পুকুরে সাঁতার কেটেছি, আমগাছের আম পেড়েছি, একসাথে বল? কতবছর বাদে দেখা হলো বল। কিন্তু তুই তো পড়াশুনায় ভালো ছিলি, চাকরী পাস নি নাকি রে?
পল্টু বললো, ক্লাস টেন-এ ওঠার সময় বাবা মারা গেল। ছোট বোন আর মায়ের মুখের ভাত জোটানোর জন্য অটো চালাচ্ছি সেই থেকে। বোনের বিয়ে দিয়েছি। মা’ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি বাড়ীতে একা থাকি। বিয়ে করিনি। কথা বলতে, বলতে রঞ্জনের বাড়ি চলে এলো। ভাড়া দিতে গিয়ে বন্ধুর হাতের স্পর্শে বুক কেঁপে উঠলো রঞ্জনের, কি বরফের মত ঠান্ডা হাত। চোখ দুটো কেমন যেন লাল। পল্টু বললো, তুই আমার বন্ধু, তোর থেকে কি আমি ভাড়া নিতে পারি বল। ভাড়া লাগবে না রে। চললাম বন্ধু, আর আমাদের দেখা হবে না বলে গাড়ী ঘুরিয়ে চলে গেল পল্টু।
আর দেখা যাচ্ছে না তো অটোটা। এই তো ছিল এর মধ্যে কোথায় চলে গেল? যাক গে বাড়ি যাই। রঞ্জনকে দেখে তার বোনেরা ছুটে এলো। কতদিন বাদে দাদার সাথে দেখা। দাদাকে এক বোন জিজ্ঞাসা করলো, এই ঝড়,জলের রাতে কিসে এলি? রঞ্জন বললো, আমার ছোটবেলার বন্ধু পল্টুর অটোতে। কি বলছিস দাদা, পল্টু তো গত বছর একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে! এবার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে লাগলো রঞ্জনের। হাত,পা কাঁপতে লাগলো। তাহলে কি বন্ধু পল্টুর আত্মা তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল? প্রচন্ড ভয় পেয়ে ঘামতে লাগল রঞ্জন।